অগ্রহায়নে বিলের ধান কাটা শেষ।
খালি ধু ধু মাঠ চারিদিকে। অহি বাড়িতে নেই। উঠোনে খড়ের গাদার উপর বসে আছে পরী। দাদীমা জয়নাব বেগম দুপুরের রোদটা গায়ে মাখার জন্য খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে বসেছে। পরীকে কাছে ডেকে বলল - আয় আমার কোলে আয়। মাথাটা একটু আঁচড়াইয়া দিই। মাথা ভর্তি উকুন। সারাক্ষণ মাথা চুলকাইতে থাকস। অহন বড় হইতাছস। বুদ্ধি হইতাছে। সাবধানে পা ফেলন লাগবো।
জয়নাব বিবির গায়ে উলের চাদর। দুপুরের রোদটা বড় মিষ্টি লাগছে। এবার শীতটাও বেশ পরছে। এরকম হাড় কাঁপানো শীতে বয়স্ক লোকদের ঠিকে থাকাটাও মুশকিল। পরী একা বসে পুতুল খেলছিল। অহিটা থাকলে ভালো হতো। সারাক্ষণ খুনসুটি লেগে থাকত। মায়ের পুরানো শাড়ীর পাড় দিয়ে শাড়ী পরিয়ে দিয়েছে পুতুলের গায়ে। আর একটা পুতুলকে সাজিয়েছে বর। একটা কাগজের বাক্সে কাপড় বিছিয়ে পাশাপাশি শুইয়ে দিয়েছে। এবার বিয়ে হবে। বাক্সের উপর আর একটা কাপড় মুড়ে দিয়ে বলল, ব্যাস এবার পুতুল বিয়ে হবে। ও নানী ল’ এবার বরযাত্রী যায়। কাগজের বাক্সটা হাতে করে নিয়ে নানীর পাশে বসল পরী। খাড়াও এবার সুতো দিয়ে বাঁধন লাগব।
অহির নাটাইয়ের সাথে অনেক সুতো। সব মাঞ্জা দেওয়া। ঘুড়িটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে খুঁজে পাচ্ছে না। নাটাইটাও লুকিয়ে রেখেছে। অহি থাকলে ঘরের চালার সাথে গুঁজে রাখে। পরী খুঁজছে। কখনও রান্নাঘরে, কখনও ঘরের চালায়। গোয়াল ঘরের ওদিকটায় ঘুরে এসেছে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। অহির বুদ্ধি আছে। যাওয়ার সময় মাকে বলে গিয়েছে, মা কাউরে কিন্তু বলবা না। আমি আইসা ঘুড়ি উড়ামু। দেখছ না বিল গুলান কেমন শুকাইয়া গেছে। এই বিলে দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া ঘুড়ি উড়াইতে যা মজা। চাচার লগে বেশীদিন থাকুম না। আইয়া পরুম। লুকোচুরি খেলায়ও বিচ্ছু। উঠোন ভর্তি খড়ের গাদার মধ্যে লুকোচুরি খেললে কারও সাধ্য নেই খুঁজে বার করবে। খড়ের স্তূপের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকে। নাটাইটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খড়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে নিশ্চয়। কিন্তু কোথায় খুঁজবে পরী। সারা উঠোন ভর্তি খড় আর খড়ের গাদা। সারা বছরের গরুর খাবার।
আজ হাট বার। রহমত মিয়া দুপুরের খাওয়া সেরে শুকনো খড়ের উপর একটা কাঁথা বিছিয়ে একটু জিরিয়ে নিল। পরীর মাকে বাজারের হাতাটা (ঝুড়ি) দিতে বলল। সুফিয়া বেগম হাতাটা দিয়ে বলল, অহনও তিনটা বাজে নাই। এত তাড়াতাড়ি বাজারে গিয়া কি করবা। একটু জিরাইয়া লও।
- না পরীর মা। তাড়াতাড়ি বাজারটা সাইরা আসি। বেগুন আর মরিচ ক্ষেতে চাষ দেওয়া হয়ে গেছে। দেখি ভালো থাইকা বেগুন মরিচের চারা পাইলে নিয়া আসুম। মাঘের শুরুতে না লাগাইলে ফসলটা ভালো হইবো না। অহিটা বাড়িতে থাকলে ভালো হইত। কাজ কামে একটু সাহায্য হইত। আমাগো শহীদটাও কেমন। এতদিন পর ভাইপোরে কাছে পাইয়া আসতেও দিচ্ছেনা। দেখি পোষ্ট মাষ্টারকে দিয়া একটা চিঠি লিখে পাঠাইয়া দিমুনে।
আমার পরী মা এত হন্যে হয়ে কি খুঁজছে। এদিক ওদিক পরীকে ঘুরতে দেখে জিজ্ঞাসা করে রহমত।
- একটু সুতো খুঁজছিলাম। অহির নাটাইটা খুঁজে পাচ্ছি না।
- তুই কই পাবি। কোথাও লুকিয়ে রেখেছে হয়তো। তোর মার থেকে একটু চেয়ে নে।
- না বাজান। অহি আমার পুতুল চুরি করেছে। আমি অর নাটাইটা লুকিয়ে রাখবো।
তোরা দুই ভাইবোন। সারাক্ষণ ঝগড়া নিয়ে লেগে থাকিস। অহি চাচার বাসায় বেড়াতে গেছে। আসলে না হয় ঝগড়া করিস। অহন সুতা কি জন্য লাগবে বল।
- বাজান, আমি পুতুলের কাপড় পরাবো।
- ও পরীর মা, আমাগো পরীরে একটু সুতা দেও।
সুফিয়া বেগম মুচকি হাসে। গোয়াল ঘর থেকে উঁচু গলায় বলল, আমি কালির দুধ দোয়াইতেছি। আইসা দিমুনে। পরীরে কও আমারে একটু ভালা (শষ্য) তেলের বোতলটা দিতে। বাটগুলান খসখসে হইয়া গেছে। আর কি যে হইলো কালিটার। খালি লাথি পারে।
পরী শষ্য তেলের বোতলটা মাকে দিয়ে বলে, মা একটু সুতা দাওতো। আমি পুতুলের কাপড় পরাইতে পারতেছি না। খালি খুইলা যাইতাছে। সুতা দিয়া বান্ধন লাগবো। সুফিয়া বেগম দুই হাতের তালুতে একটু শষ্য তেল মেখে নেয়। দুই হাটুর মাঝখানে বালতিটা চেপে ধরে ওলানে তা দিতে দিতে বলে তুই একটু কালিটার গলায় হাত বুলিয়ে দে তো মা। কালিটা বড় বেয়ারা হয়ে গেছে। পরী কালির গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কালি চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। আর শিং নাড়াচ্ছে না। পরীর আদর পেয়েছে। একটু দুরে খুটির সাথে বাছুরটা বাঁধা। বাছুরটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কালি।
বিকালের দুধটুকু গোয়ালাকে দেয় না। বাছুরও বড় হচ্ছে। দুধও কমে আসছে। রহমতের বারন আছে। আগে আমাগো ছেলে মেয়ে খাইয়া বাঁচলে তারপর গোয়ালাকে দিবা। দুধ হইলো ভালা জিনিষ। মাথার ঘিলু বাড়ে। বুদ্ধি শুদ্ধিও বাড়ে। অহির খুব পছন্দ দুধের কড়াইটা। কড়াইতে লেগে থাকা ঘন দুধের ছানাটা চামচ দিয়ে চেঁচে খেতে খুব ভালোবাসে। মাঝে মধ্যে ক’টা মুড়ি দিয়ে মেখে নেয়। এই নিয়েও এক পশলা হয়ে যায় ভাই বোনের ঝগড়া। পরী অভিযোগ করে অহি ছেলে বলে শুধু সে-ই ছানা খেতে পারে। পরীকে সেভাবে খেতে দেয় না। এখন অহি নেয়। ভালোই হয়েছে। দুধের কড়াইটা পরী একাই চেটে পুটে খাচ্ছে।
বাজারের আগেই পোষ্ট অফিসটা। এক কামড়ার বেড়ার ঘর। গাছের খুটি। একটা চেয়ার আর একটা টেবিল। আশে পাশে পাঁচ গ্রাম মিলে একটা পোষ্ট অফিস। মানুষজনের আনাগোনার কমতি নেই। আশে পাশের প্রায় সব মানুষগুলোকে ডাক পিয়নের চেনা। আজ হাটে বসে চিঠি বিলি করবে। তাই ডাক পিয়ন আগে ভাগে রমজানের দোকানে গিয়ে বসেছে। তাতে কেউ কেউ দু’চার আনা বকশীষ দেয়। আবার কেউ চা ও পান বিড়ি খাইয়ে চিঠিটা পরিয়ে নেয়। কোন কোন সময় চিঠি লেখার কাজটাও করে। তবে পোষ্ট মাষ্টার বিভূতি বাবুর হাতের লেখাটা সুন্দর। গুছিয়ে লিখতে পারে বলে অনেকে তার কাছে আসে। বিনিময়ে দু’এক টাকা দিলে খুশী হয়। না দিলেও খুশী মনে মেনে নেয়।
বিভূতি বাবু বসে আছেন চেয়ারে। চেয়ারের একটা পা ভাঙ্গা। গাছের খুটির সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা। রহমতকে বাজারের হাতা নিয়ে ডুকতে দেখে বলল-
- কি ব্যাপার রহমত মিয়া। আজ যে বড় সকাল সকাল হাটে যাইতাছ। মেহমান আইবো বুঝি।
- না গো বাবু। আমাগো শহীদের কোন চিঠি পত্র আছে।
- না। কেন শহীদের কি হইছে। এই সেদিন না আইলো।
- কিছু হয় নাই। যাওনের সময় বলল অহির পরীক্ষা তো শেষ। আমার লাগে কয়দিন ঢাকায় বেড়াইয়া আসুখ। অহিতো মহা খুশী। চাচার লাগে যাইবোই। আর মানা করি কেমনে।
- ভালা করছ রহমত মিয়া। পোলাপানগুলা দেশ বিদেশ ঘুরলে জ্ঞান বুদ্ধি বাড়ে। নানান কিছু দেখে। নানান কিছু শিখে। এতে পথ চলতে সুবিধা হয়।
- জীবনে এই প্রথম ঢাকা শহর দেখতে যাইতাছে। একি কম আনন্দের কথা। আমি তো এই বয়সে আমাগো শহরই দেখি নাই।
- ঠিকই তো কইছ। তাছাড়া তোমার ভাই আছে বইলাই তো সুযোগটা পাইছে। ক’জনার সেই সুযোগ আছে।
- এটা বাবু ঠিক বলেছেন। আমি লেহাপড়া না করতে পারি। ভাইটারে লেখাপড়া শিখাইতে পাইরা বড় ভালা লাগছে। ঢাকা ইনিভার্সিটিতে পড়ে। কত বিদ্বান হইছে। অথচ অহনও বাড়ী আইলে পায়ে হাত দিয়া আমারে সালাম করে। অর ভাবীরে সালাম করে। গর্বে আমার বুকটা ভইরা যায় বাবু।
- দেখবা তোমার পোলাটাও ওর চাচার মত অনেক বড় হইবো। লেখাপড়া শিখবো।
- আমি চাষা ভূষা মানুষ বাবু। পোলাটারে মানুষ করতে পারলেই আমার শান্তি। আজ ক’দিন ধইরা পোলাটা ঘরে নাই। মনটাও কেমন করছে। তাই ভাবলাম আপনেরে দিয়া একখান চিঠি লিখাইয়া দেয়। যাতে তাড়াতাড়ি ফিইরা আসে।
বিভূতি বাবু পুরু মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা পরে নিলেন। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে টিটোনি কলমটি বের করলেন। একটা সাদা কাগজের পৃষ্টা ছিড়ে বললেন-
- বল কি লিখতে হবে। ঢাকা শহরের অবস্থা কিন্তু বেশী ভালা না। সারা শহরে ২১-শে ফেব্রুয়ারী থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ সহ সমস্ত এলাকা পুলিশ ঘিরে রেখেছে। পাঁচ জনের বেশী লোককে একসাথে দেখলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে নাকি গুলি করারও নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
- এ আপনি কি কন। কি হইছে আবার দেশে। এইতো ক’দিন আগে দেশ ভাগ হইলো। অহন আবার কি আলামত শুনতেছি। বিস্ময় প্রকাশ করে রহমত।
- কি আর হইবো। পশ্চিম পাকিস্থানীরা উর্দ্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বলছে উর্দ্দু-ই হবে সমগ্র পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু আমাদের পূর্ব পাকিস্থানীরা সেটা মানতে নারাজ। আচ্ছা তুমি কও আমরা মানবই বা কেন। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। উর্দ্দু যদি রাষ্ট্রভাষা হয় তাহলে আমাদের পূর্ব পাকিস্থানীদের হাল চাষ করা ছাড়া করার কিছুই থাকবে না।
- উত্তেজিত হয়ে উঠে রহমত। না না এটা ক্যামনে সম্ভব। বাংলা আমাগো ভাষা। আমরা বাংলায় চিঠি লিখি। বাংলায় গান গায়। আবার উর্দ্দু শিখতে যামু ক্যান।
বিতূতি বাবু প্লাষ্টিক টিউব দিয়ে দোয়াত থেকে কলমে কালি ভরে নিলেন। কলমটা ঝেড়ে নিয়ে নিভটা পরিষ্কার করলেন। হাতগুটিয়ে কিছুক্ষন বসে থেকে কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন- এইতো গত ৩১ শে জানুয়ারী মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রিয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠন করা হয়েছে। তারা ২১-শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে হরতাল, সভা, সমাবেশ ও মিছিলসহ বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহন করেছে। অথচ ঐ দিনই ১৪৪ ধারা জারি করেছে সরকার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-
- ঐ দিন, কি যে হয় ভগবানই জানেন। বল তোমার চিঠিতে কি লিখতে হবে।
- বাবু আপনে একটু ভালো কইরা লিখে দেন যেন ওরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিইরা আসে। আমি আর কি কমু। আমার সারা শরীর কাপঁতাছে। আপনে আপনের ভাইরে যেভাবে লিখতেন, আপনের পোলারে যেভাবে লিখতেন ঠিক সেভাবেই লিখে দেন। আর চিঠিটা যেন তাড়াতাড়ি পায় সে ব্যবস্থা করেন বাবু।
শহিদুল চিঠিটা হাতে পেয়ে খুশী হয়। ইউনিভার্সিটির সামান্য দূরে ছোট এক রুমের বাসা। সাব-লেট নিয়ে থাকে। বাংলায় অনার্স করছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। টিউশনি করে। তাতে নিজের হাত খরচটা উঠে আসে। বাড়ী থেকে আসার সময় বড় ভাইজান জোড় করে চাল দিয়ে দেয়। শহিদুল আনতে চায় না। তাতে রাগ করে রহমত। যতটুকু সম্ভব কিছু টাকা হাতে দিয়ে বলে বলে-তোর কিছু ভাবতে হবে না। শুধু মন দিয়ে লেখাপড়া করবি। আর অনেক বড় মানুষ হবি। পারলে যেন তোরে আমার কইলজাটায় দিয়া দিই। হেই তৌফিক তো আল্লাহ আমারে দেয় নায়।
অহি খাটের উপর বসে একা একা লুডু খেলছিল। এতক্ষন এই বাসার সাকিব ছিল। অহির সমবয়সী। নয় দশ বছর বয়স। অহির সাথে খুব ভালো ভাব হয়েছে। গন্ডগোলের জন্য স্কুল বন্ধ। তাই অহির সাথে সাকিবের সময়টা ভালোই কাটছে। চাচাকে একটা বড় থলে আর হাতে অনেকগুলো কাগজ নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল-
- ও চাচা, এত কাগজ পত্র দিয়া কি করবেন। মেলা বাজার নিয়া আসছেন। খাইবো কে।
- আপনি বুঝবেন না অহিউল্লাহ সাহেব। এই নেন আপনার বাপ জানের চিঠি। দেখি কি লিখেছে একটু পড়ে শোনানতো।
অহি অতসব জিনিষের কথা ভূলে যায়। তাড়াতাড়ি বাবার চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল - ওমা এতো আমাগো পোষ্ট মাষ্টারের হাতের লেখা। বা’জান বুঝি তাড়াতাড়ি যাইবার কইছে। পরী’বু কেমন আছে। আমার ঘুড়ি খান মায় ঠিকঠাক রাখছে কিনা কে জানে।
- সব ঠিক আছে। কই চিঠিটা পড়ে শোনালি না।
- আমি এত টানা হাতের লেখা পড়তে পারি নাকি। ও চাচা, আপনে বলেন না কি লিখছে।
- লিখছে আমাদের জন্য তোর মা বাবার খুব খারাপ লাগছে। বলেছে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য।
- আমরা কখন যামু চাচা।
- আর ক’টা দিন পরেই যাবো বাপ। দেখছস না আমার উপর কত দায়িত্ব। কত সব কাগজ পত্র। কত কাজ।
- এত সব কাগজপত্র দিয়া আপনের কি কাম। আপনে ত খালি বই খাতা নিয়া লেখাপড়া করেন।
শহীদুল অহির মাথায় হাত রাখে। আদর করে পাশে বসিয়ে বলে-
- না রে বাপ। এগুলো হলো দেশের কাজ। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আর এই বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য শহরে এখন খুব গন্ডগোল হচ্ছে। ২১শে ফেব্রুয়ারী আমাদের মিছিল মিটিং হবে। ঐ মিটিং-এর আগে আমাকে একশ’টা পোষ্টার লিখতে হবে। এটা আমাদের এখন অনেক বড় কাজ।
অহির মাথায় কিছুই আসছে না। রাষ্ট্রভাষা, মাতৃভাষা, গন্ডগোল কিছুই মিলাতে পারছে না। জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা চাচা মাতৃভাষা কি।
- দূর বোকা। তাও জানস না। এই যে এখন আমরা যে বাংলা ভাষায় কথা বলছি, সেটাই আমাদের মাতৃভাষা। না, হাতে আর বেশী সময় নেই। কাল বাদে পরশু ২১ তারিখ। পোষ্টারগুলো লিখে দেওয়ালে দেওয়ালে লাগাতে হবে। তাড়াতাড়ি দুইটা ডিম আর ভাত রান্না করে নিই। সারারাত জেগে এগুলো সব লিখতে হবে।
- রান্না করতে হবে না। সাকিবদের বাসায় আমাদের দুইজনরে দাওয়াত দিছে।
- তাহলে তো ভালোই হলো। লেখার কাজটা শুরু করি। তুই একটা লিখবি নাকি।
- আমি কি আপনের মত সুন্দর কইরা লিখতে পারুম। আমি আপনের লগে বইসা বইসা দেখব।
অহি অনেক রাত জেগে চাচার সাথে বসে দেখল কিভাবে পোষ্টার লিখতে হয়। চাচা একের পর এক রং তুলি দিয়ে পোষ্টার লিখে যাচ্ছে। ”মোদের গরব মোদের আশা, আ’মরি বাংলা ভাষা” ”রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” আরও কত স্লোগান। অহি বসে বসে দেখছে আর চাচাকে মাঝে মধ্যে রং তুলি আর কাগজ এগিয়ে দিচ্ছে। ঘুমে ঢুলু ঢুলু করছে চোখ। তবুও বসে আছে। শহীদুল বলল, তুই ঘুমিয়ে পর। ছোট অহি বলল, চাচা আর একটু দেখি। শহীদুল একটা লেখা পোষ্টার দিয়ে বলল, নে এইটা দেখে দেখে লাল রং দিয়ে তুই একটা লেখ। অহি অনেক খুশী। যেন এটাই চাইছিল। অহিকে চাচা দেখিয়ে দিল তুলি কিভাবে ধরতে হবে। অহি ভাঙ্গা ভাঙ্গা অক্ষরে লিখল ”মোদের গরব মোদের আশা, আ’মরি বাংলা ভাষা”। শহীদুল দেখে বলল, বাহ! খুব সুন্দর হয়েছে। এইটা তুই রেখে দে।
কাক ডাকা ভোরে পোষ্টার নিয়ে বেরিয়ে পরেছে শহীদুল। বন্ধুদেরকে পৌঁছাতে হবে। কাল ২১ শে ফেব্রুয়ারী। আজ রাতের মধ্যে সবাই মিলে পোষ্টার লাগাবে। এর মধ্যে সাকিব এসে অহিকে জাগিয়ে দিল। তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। দুপুরে একবার এসে আবার বেরিয়ে পড়ল শহীদুল। বলে গেল ফিরতে রাত হবে। বাইরে যেন কোথাও বের না হয়। রাতে যখন ফিরেছে তখন অহি ঘুমিয়েছে। পোষ্টারটা বালিশের নীচে ভাঁজ করে রেখে দিয়েছে। বলেছে ওটা বাড়িতে নিয়ে যাবে। ফিরতি চিঠিতে শহীদুলও ভাইকে জানিয়ে দিয়েছে এখন শহরের পরিস্থিতি ভালো না। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে আমি অহিকে নিয়ে ফিরে আসবো।
রহমত মিয়া ক্ষেতে মরিচের সারি গুলো দেখছে। চিকন লিকলিকে নুইয়ে পরা মরিচের চারাগুলো আস্তে আস্তে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে যাচ্ছে। বেগুন চারাগুলোও কেমন তরতাজা হয়ে উঠছে। এবার একটু পানি দিতে হবে। সুযোগ পেলেই পোষ্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নেয়। বিতূতি বাবুর কাছ থেকে ঢাকার খবরা খবর জেনে আসে। চিঠি আসে না। রহমত আলীর ভয় আরও বেড়ে যায়। যখন শুনে সমস্ত ছাত্ররা এই আন্দোলনে শরীক হয়ে রাস্তায় নেমে আসছে।
আজ খুব ভোরে বেরিয়ে পরেছে শহীদুল। রাতে ঘুমাতে এসে অহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আর অহি ঘুমের ঘোরে বার বার বলছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই-- মোদের গর্ব মোদের আশা, আ’মরি বাংলা ভাষা। শহীদুল অবাক হয়ে স্পষ্ট শুনছে। অহির কপালে একটা চুমু দিয়ে আদর করে।
শীতের কুয়াশা কাটতে না কাটতেই সারা শহরে আতংক ছড়িয়ে পরে। চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ। অহি ভয়ে অস্থির। চাচা এখনও ফিরে আসেনি। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। দুপুরের পর আবার চারিদিকে মিছিল। অহি নিজের হাতের লেখাটা বুক পকেটে ভাঁজ করে রাখে। চাচার হাতে লেখা পোষ্টারগুলো দেখবে বলে একা রাস্তায় বেরিয়ে পরে। ভয়ও হচ্ছে। বড় রাস্তাটা বাসা থেকে বেশী দূরে নয়। সাকিবের সাথে বড় রাস্তায় এসেছে অনেকবার। আবার ফিরেও গেছে।
অনেকগুলো লোক শহীদুলের লেখা ব্যানার, পোষ্টার, ফেষ্টুনগুলো উঁচিয়ে ধরে শ্লোগান দিচ্ছে। হঠাৎ চারিদিক থেকে এলাপাতাড়ি গুলির শব্দে লোকজন দিগ¦বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। অনেকেই মারা গেল গুলিতে। একসময় সবকিছু নিস্তব্দ হয়ে গেলো।
পরদিন সকালে খবরের কাগজে অনেক শহীদের আত্মত্যাগের কথা ছাপা হলো। তারই মাঝে একটা সংবাদ ছাপা হলো যে, এই সংগ্রামে অহিউল্লাহ নামে আট নয় বছরের একজন ছোট কিশোর প্রাণ হারিয়েছে। মৃত্যর আগে সে বার বার বলছিল, বা’জান আমার ঘুড়িটা পরী’বু-রে দিয়া উড়াইয়া দিও।
লেখকের বক্তব্য:
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী মহান ভাষা আন্দোলনে অহিউল্লাহ নামে ৮/৯ বছরের একজন কিশোর শহীদ হয়েছেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দ্যেশে উৎসর্গীকৃত এই গল্পটি সম্পূর্ন কাল্পনিক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সুত্র:
১) উইকিপিডিয় (মুক্ত বিশ্বকোষ, ভাষা আন্দোলন থেকে)
২) ডঃ সৌমিত্র শেখর, বাংলা দর্পন।
০৭ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১১৩ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৭৫
বিচারক স্কোরঃ ৩.৫ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.২৫ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪